রকাহোলিক

তানভীর হোসেন- ব্লুজপুত্র ও তার রংচটা ফেন্ডার স্ট্র্যাটোকাস্টার

কথিত আছে যে, একবার জিমি হেনড্রিক্সরে বলা হইছিল, জগতের শ্রেষ্ঠ গিটারিস্ট তো আপনি, তা এই ফিলিংসটা কেমন? হেনড্রিক্স নাকি উত্তরে কইছিলেন, এইটা ররি গ্যালাঘাররে জিগান, উনিই ভাল কইতে পারবেন।

তো এই হইলো ররি। আইরিশ জেনোটাইপ, ফেনোটাইপের এই ব্লুজ মায়েস্ত্রো তার পুরান, ডিকেয়িং ফেন্ডার স্ট্যাটোকাস্টার দিয়া হেনড্রিক্সের বহু আগে থিকাই মাতায়ে রাখছিলেন ব্লুজ আর রক অ্যান্ড রোলের জগত। সারা বিশ্বে লাখ লাখ কপি বেচা হইছে তার অ্যালবাম। কিন্তু নিজে কখনও মেনস্ট্রিম মিউজিক সিনে আসেন নাই। রোড শো, কনসার্ট কইরা বেড়াইছেন বিস্তর। আজীবন থাকছেন মানুষের কাছাকাছি।

গিটারে তার দখল এতোটাই ছিল যে ১৯৭৩ এ মিক টেইলর বাইর হইয়া গেলে সে সময়কার ব্যাডাস ব্যান্ড ‘দ্যা রোলিং স্টোনস’ তারে নিজেদের দলে নেয়ার প্রস্তাব দেয়। মাগার ররি রাজি হন নাই ৷

১৯৯৫ সালের জুন ১৪ এ ৪৭ বছর বয়সে মরার পর থিকা পার হইয়া যাওয়া সময়গুলায় ররি’র বিশালতা ক্রমেই বড় হইয়া ধরা দিছে ব্লুজ, রক শ্রোতাদের কাছে। বিনয়ী এই আইরিশম্যান স্টেজে তার ট্রেডমার্ক শ্রমিক পোষাক দিয়া নিজেরে নিয়া গেছিলেন অন্য একটা লেভেলে।

গুরুহীন এই গিটারিস্ট তার দেশে মোটামুটি একটা মিউজিকাল বিপ্লবই ঘটায়ে ফেলেন। খ্যাতি আর স্টারডম এড়াইয়াও তিনি আন্তর্জাতিক একজন ফোক হিরো হিসাবে স্বীকৃতি পাইছিলেন।

এরিক ক্ল্যাপটন তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাইতে গিয়া একবার কইছিলেন, ররিই আমারে আবার ব্লুজে ফিরাইয়া আনছে ।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারে আদর্শ মাইনা গিটার বাজায়ে গেছে, বাজাইতেছে, গাইছে, গাইতেছে। স্ল্যাশ থিকা জনি মার, ইউ টু’র দ্যা এজ থিকা কুইনরর ব্রায়ান মে, দ্যা ম্যানিক’র জেমস ডিন ব্র্যাডফিল্ড যেই তার দেখা পাইছে তার থিকা শক্তি পাইছে বা বদলায়ে গেছে।

দ্বিতীয় যুদ্ধোত্তর সময়ে উইঠা আসা সমস্ত গিটারিস্টদের মধ্যে ররি গ্যালাঘার একজন। তার নিয়তিই ছিল সেল্টিক ওয়ারিয়র কিং হইয়া ওঠা। কাকতালীয় হইলেও আয়ারল্যান্ডের শেষ রাজার নামে নাম তার। জন্ম রক হসপিটাল, বালিশ্যানন, ডোনেগাল এ ১৯৪৮ সালে।

বাপ ছিলেন হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্টের কনস্ট্রাকশন শ্রমিক ।

এরপর থিকা ধীরে ধীরে কি ইলেকট্রিক ফায়ারপাওয়ার কি অ্যাকুস্টিক মাস্টারি সব জাগাতেই তার মহীরূহ হইয়া ওঠার শুরু । মাল্টি ইন্সট্রুমেন্টালিস্ট এই প্রডিজি সব সময়ই নিজের গিটার প্লেয়িংয়ে একটা হিউম্যান ফিলিং রাখার চেষ্টা কইরা গেছেন। আর তা যতো এফএক্স আর গিজমো দিয়াই হোক না কেন, সেগুলার সাথে নিজের জিনিয়াস স্ট্রিং বেন্ডিং মিশায়া একটা র আর আদিম স্বাদ উপহার দিতে মুখায়ে থাকতেন তিনি সবসময় ।

আর এগুলাই তারে আইনা দেয় ‘মানুষের গিটারিস্ট’ খেতাব। গিটারের তারে তার আঙুলর প্রতিটা ছোঁয়ার মধ্যে দিয়া টের পাওয়া যাইতো কঠোর পরিশ্রম, সাধনা ।

গিটার ছাড়াও ম্যান্ডোলিন, স্যাক্সোফোন বাজাইতে পারা ররি’র লিরিক লেখার হাতও ছিল দারুণ। সাথে ছিল অসাধারণ ভয়েস ।

‘ওয়াক অন হট কোলস’ কিংবা ‘আ মিলিয়ন মাইলস আওয়ে’র মতো লিরিক যিনি লেখতে পারেন তিনি আর যাই হন না ক্যান কবি তো বটেই ৷

বুকে লুকায়ে থাকা ব্লুজ থিকা বাইর হওয়া এইসব গানগুলার প্রত্যেকটা শব্দ আপনারে মোহিত করবেই।

১৯৫০ এর দিকে কর্ক শহরে প্রিটিনেজ কাটানো ররি’দের বাসায় কোন রেকর্ড প্লেয়ার ছিল না। যা তার জন্যে শাপেবরই হইছিল অনেকটা। তখন থেকেই তার ভিতর একটা অরিজিনালিটি তৈরি হইতে থাকে। পরে যখন এলভিস প্রিসলিসহ ফার্স্ট লটের অন্যান্য রক অ্যান্ড রোলারদের দেখলেন শুনলেন তখন ব্লুজের প্রতি আগ্রহ আরও মাথাচাড়া দিয়া উঠলো। সন্ধান পাইলেন মাডি ওয়াটারস এর। এদের নিয়া একবার তিনি কইছিলেন, ‘যতোই শুনতাম ততোই আসক্ত হইয়া পড়তাম ।

ততোদিনে অবশ্য তিনি একটা লোকাল ট্যালেন্ট শো জিতে স্টার বইনা গেছেন। আর সেইখান থিকা পাওয়া পুরস্কারের পয়সা দিয়া কিনে ফেলছেন ১৯৬১’র সেই বিখ্যাত ফেন্ডার স্টাটোকাস্টার যা পরে গিয়া তার কড়া অ্যালকালাইন ঘামে ভিজে ভিজে হারাইয়া ফেলছিল নিজের রঙ কিন্তু বাড়াইয়া দিছিলো ব্লুজের নীল। আর এসবের ভিতর দিয়া গিটারটা হইয়া উঠছিল একটা টোটেমিক টুল।

প্রথমদিকে নানান শো ব্যান্ডে বাজাইয়া নাম কামান তিনি। কিন্তু যখন সেগুলা ছাইড়া দেশে ফিরলেন আর জয়েন করলেন ‘টেস্ট” এ তখনই মূলত তার ভেল্কিবাজির শুরু হইলো। তিনি হইয়া উঠলেন সেন্টার স্টেজের রাজা । টেস্ট রাতারাতি সেনসেশন বনে গেল। সংক্ষিপ্ত অথচ অসাধারণ একটা যাত্রার পর ম্যানেজারিয়াল দ্বন্দ্বের খেসারত দিতে গিয়া অবশেষে থাইমা যায় টেস্ট’র সেই যাত্রাটা ।

এরপর ররি একলাই শুরু করেন হাঁটা। সেল্ফ টাইটেল্ড সোলো অ্যালবামটার পর থেকে একে একে বাইর করেন ‘ডিউস’, ‘ব্লুপ্রিন্ট’, ‘ট্যাটু, ‘এগেইন্সট দ্য ট্রেইন’, ‘কলিং কার্ড’, ‘ফোটো ফিনিস’, ‘টপ প্রায়োরিটি’ ইত্যাদি অ্যালবামগুলা।

একমাত্র ভাইরে সাথে নিয়া তিনি আয়ারল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথম রক ফেস্টের আয়োজন করেন। যা কিনা পরে গিয়া ইউ টু’র মতো ব্যান্ডদের স্টেডিয়াম রকের ধারণা দিছিলো । সেলিব্রেটি স্টেটাসরে ভয় পাইতেন ররি। ১৯৭২ এ রোলিং স্টোনরে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, ‘বছরের পর বছর একটানা কাজ কইরা যাওয়ারে আমার অপচয় বইলা মনে হয়। এইভাবে আপনি নিজের মিউজিকটা বুঝতে থাকেন তারপর সেইটা নিয়া বড় একটা কিছু করেন যা অন্যরাও করে শুধুমাত্র একটা ব্যক্তিত্ব গইড়া তুলতে। একটু কম বাজান, কম পারফর্ম করেন, নিজেরে কম ছড়ান তাইলে দেখবেন ব্যাপারটা পুরা অন্যরকম কিছু বয়ে নিয়া আসবে।’

আর এইরকম চিন্তা থিকাই পরে সিঙ্গেলস বাইর করা একেবারেই বন্ধ কইরা দেন। যদিও ১৯৭৬ এ বাইর হওয়া ‘এজড ইন ব্লু’ ছিল ইউএস টপ চার্টের শীর্ষে।

সব ছাইড়া ছুইড়া তিনি বারবার ছুইটা গেছেন স্টেজে, মানুষের কাছাকাছি। আর তা এতো বেশি যে কখনও কখনও বছরে তার গিগের সংখ্যা তিনশ-ও ছাড়াইয়া যাইতো। যা তার শরীরে প্রভাব ফেলতে শুরু করে ধীরে ধীরে।

এই কারণে তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘দ্যা ব্লুজ ইজ ব্যাড ফর ইয়োর হেলথ।’

সারাজীবন অবিবাহিত থাকা এই লোকটার কখনও কারও সাথে দীর্ঘস্থায়ী কোন সম্পর্কও ছিল না। যেন তিনি জানতেন যে ওই গিটারটাই তার সব। ফলে কোন উত্তরাধিকারও নাই তার। একবার এক সাক্ষাৎকারে এ কারণেই হয়তো কইছিলেন, ‘এই গিটারটাই তো আমার সন্তান ।

আয়ারল্যান্ড তার ব্লুজপুত্ররে যোগ্য সম্মানই দিছে। জন্মস্থান ব্যালিশ্যাননে বানাইছে গ্যালাঘারের ব্রোঞ্জ মূর্তি। কর্ক শহরে আছে আরেকটা ভাস্কর্য, সেইখানকার একটা থিয়েটারও তার নামে। ডাবলিনে আছে একটা গিটার। একটা প্লেক আছে বেলফাস্টে। আর তার রংচটা সূর্যালোকের বিচ্ছুরণঅলা ফেন্ডারটার আদলে ফেন্ডার কোম্পানি বাইর করে একটা ট্রিবিউট মডেল। প্যারিসেও আছেন। সারা বিশ্বের নানান জাগায় তার নামে কনসার্ট ফেস্টিভ্যাল হয় এখনও ৷

আসলে ররি কথা বইলা শেষ করার মতোন না। তাই অসংখ্য ডিভিডি পাওয়া যায় তার লাইভ পারফরম্যান্সগুলার। আছে একটা ওয়েবসাইট।

ব্লুজান্ধ এই মায়েস্ত্রো ভালবাসতেন নিজের গিটার আর মদ। মিউজিসিয়ানরা বলেন মিউজিক করতে করতেই যেন মৃত্যু হয় তাদের। ররির লিটারালি তাই হইছিল। ১৯৯৫ এ রটারড্যামে পারফর্ম করার এক পর্যায়ে স্টেজেই পইড়া যান তিনি। লিভার সিরোসিসে ঘায়েল হইছিল লিভার অনেক আগেই। ফলে হাসপাতালে নেয়ার দিন কয়েক মাস পর মারা যান তিনি ।

মইরা তো সকলেই যায় কিন্তু ররি গ্যালাঘারের মতো মইরাও বাঁইচা থাকেন আর কয়জন!

I’m a million miles away,

A million miles away,

I’m sailing like a driftwood on a windy bay,

Send me away…

-Rory Gallagher