“ঘুম ভাঙল ফোনে। তুই ঘুমাচ্ছিস?’
‘হু।’
‘শোন, আইয়ুব বাচ্চু, বাচ্চু ভাই মারা গেছেন । যিনি কথাটা বললেন, তিনি এলাকার বড় ভাই । চারদিন আগে বিয়ে হয়েছে। স্ত্রীকে নিয়ে কাজারে গেছেন। কাছে থাকলে বলা যেতো, ভাই, আমি আপনাকে চিনি। আপনি সারাক্ষণ ফেসবুকে থাকেন। জাকারবার্গের দুনিয়া ভুয়া খবরে ভর্তি। সেলেব্রেটিদের নিয়ে এ’রকম খবর ছড়ায়। আমার সঙ্গে গসিপ করবেন না প্লিজ।
কথাটা বলা গেল না। মনে পড়ল, লোকটা হানিমুন থেকে ফোন করেছেন। হানিমুন থেকে কেউ ব্যাচেলরদের সঙ্গে মজ্জা করে না।
আমি লাইন কেটে দিলাম ।
শুরু হল অবিশ্বাসের সঙ্গে যাপন। এইতো সেদিন ক্লাস সেভেনে পড়ি- বৃষ্টি পড়ছে। টিফিনের ছুটি। স্কুলের সামনেই পেট্রোল পাম্প। সেটা পার হবো, কিন্তু এগুতে পারছি না। পাম্পের কর্মচারীরা একটা প্রাইভেট কার ঘিরে রেখেছে। বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি। আমি পাম্পের এক কর্মচারীকে সরতে বললাম। তিনি কথাটা বুঝতে পারলেন না। আমাকে বললেন, আইয়ুব বাচ্চুকে দেখবা? বলেই একটু সরলেন। আমি প্রাইভেটকারের ভেতরে তাকালাম। চালকের সিটে আইয়ুব বাচ্চুকে দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে তিনি তেল নিচ্ছেন।
কাজেই, বারবার মনে হলো, কেউ কেউ না কেউ বলবে খবরটা ভুল ছিল। কিন্তু তা হল না। সম্ভবত আইয়ুব বাচ্চু এমন একজন সেলেব্রেটি অনলাইনে যার অগ্রিম মৃত্যু সংবাদ বের হয়নি। যখনই হয়েছে- তার নামের সঙ্গে যারা পরিচিত, সবাই নড়েচড়ে বসেছেন। অসংখ্য গল্প উঠে এসেছে এতে।
এবার একটা ধার করা গল্প বলা যাক- চট্টগ্রাম শহরের অল্পবয়সী একটা ছেলের নিজের গাড়ি আছে। সেই গাড়ি নিয়ে সে এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য আইয়ুব বাচ্চুকে রিসিভ করা। তার ভেতর উত্তেজনা হচ্ছে। সঙ্গে দুশ্চিন্তাও। তার গাড়ি মাঝে মাঝেই বন্ধ হয়ে যায়। ফেরার পথে সেরকম কিছু ঘটবে না তো?
মানুষ যা-নিয়ে দুশ্চিন্তা করে তার সঙ্গে সেটাই ঘটে। এরকম একটা কুফা প্রবাদ আছে। ফেরার পথে জ্যামের মধ্যে ছেলেটার দুশ্চিন্তা সত্যি হয়ে গেলো।
ধরা যাক, এই জ্যামের ভেতর একজন বয়স্ক ফেরিওয়ালা ম্যাঙ্গোবার বিক্রি করেন। তিনি গাড়ির আয়নার দিকে তাকাতেই ভেতরের মানুষটিকে চিনে ফেললেন। আরে, আইয়ুব বাচ্চু না? কত গান শুনেছেন তার! লোকটা মনোযোগ আকর্ষণ করলেন। আইয়ুব বাচ্চু সাড়া দিলেন। লোকটা তাকে দুটি ম্যাঙ্গোবার বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘ভাই, এটা আপনি আমার সামনে খাবেন। আপনাকে তো আর আমি পাব না ।
পারফর্মারদের মানুষকে খুশি করতে হয়। আইয়ুব বাচ্চু ম্যাঙ্গোবার খাওয়া শুরু করলেন। আর একটা ম্যাঙ্গোবার এগিয়ে দিলেন যার গাড়িতে বসে আছেন তার দিকে। ছেলেটা বিব্রত। আইয়ুব বাচ্চু তাকে সহজ করার জন্য বললেন, এ দেশের মানুষের ভালোবাসার প্রকাশটা এরকমই। আমি কিছু মনে করিনি ৷
এই ধার করা গল্পটা বলার একটা কারণ আছে। প্রথমত এটা দেশি উদাহরণ। যদিও কাউকে মাথার ওপর তুলতে আমাদের বিদেশের আলৌকিক ঘটনা টেনে আনতে হয়। এতে কী লাভ হয় জানি না। দ্বিতীয় কারণটা পরে বলি?
এরকম গল্পের সংখ্যা অসংখ্য এবং তা বলা আমার উদ্দেশ্য না। আমি এটা টেনে আনলাম কারণ, জীবদ্দশায় আইয়ুব বাচ্চুকে মিডিয়া চাইলেই কাছে পেত। এতো মিডিয়া ফ্রেন্ডলি সেলেব্রেটি সচরাচর পাওয়া যায় না ৷
তো, বাংলাদেশের বিনোদন সাংবাদিকদের হৃদয়ে তার জন্য আলাদা একটা জায়গা আছে, এটা বুঝতে বুদ্ধিমান হতে হয় না। তাদের অনেকেই এখন আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে স্মৃতিকথা লিখবেন। বই করবেন। যারা এসব করবেন, তাদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে। আইয়ুব বাচ্চুর কোনো ভাল সাক্ষাৎকার নেই কেন?
আমি একবার আইয়ুব বাচ্চুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি আত্মজীবনী লেখেন না কেন? তিনি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। সময় পেলে হয়তো লিখতেন। সময় পাননি। এখন, সেই মানুষটার জীবন অন্যরা লিখে দিচ্ছেন।
আইয়ুব বাচ্চু প্রথম হিট গানের দেখা পেয়েছিলেন দ্বিতীয় সলো অ্যালবামে ৷ গানটির নাম ‘ময়না।’ সামান্য মনে করিয়ে দিই? যাদের স্মৃতিশক্তি ভালো, তাদের ভালো লাগতে পারে :
‘ময়না, এখনো আমার জন্য
রাত্রি জাগে না
কবিতার লাইন চুরি করে
চিঠি লিখে না
সেই ময়না এখন অন্য কারো
আমার কেহ না।’
অনেকে অবাক হতে পারেন, মিলন খানের লেখা এই গানের জনপ্রিয়তার কারণে গায়ককে সে সময় ‘ময়না বাচ্চু’ নামে ডাকা হত। পরবর্তীতে সেই নাম ধুয়ে মুছে গেছে।
তার জীবনের দীর্ঘ একটা সময় কেটেছে সোলসে। সোলস থেকে তাকে বের হয়ে যেতে হয়েছিল। যে দু-তিনটি গান নিয়ে তিনি বের হয়ে গিয়েছিলেন, তার একটি ‘একদিন ঘুম ভাঙ্গা শহরে।’ এলআরবির প্রথম ডাবল অ্যালবামের গান। এই গানটি সোলসের হতে পারতো। হয়নি। সেই সোলসের প্রথম বুড়িয়ে যাওয়া । ক্যাসেটের হিসাবে ‘ঘুম ভাঙা শহরে’ এলআরবির প্রথম গান। এই একটা গান বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকের মাইলস্টোন। শহীদ মাহমুদ জঙ্গির লেখা এই নাগরিক চিত্রকল্প অনুপ্রেরণা দিয়েছে পরবর্তী জেনারেশনের ব্যান্ডগুলোকে। এর তালিকায় রয়েছে আর্টসেলের মত ব্যান্ডও।
এলআরবির অ্যালবামের সংখ্যা অনেক। মিড্ড এ্যালবামেও অনেক গান আছে। ১৯৯৮ সালের পরের গানগুলা শুনলে অনেকেই বিভ্রান্ত হতে পারেন, কিন্তু ১৯৯২-১৯৯৮ পর্যন্ত এই ব্যান্ডটি যা করেছে তা দেখার মতো। আত্মপ্রকাশের পরের বছর মানে ১৯৯৩ সালের ‘সুখ অ্যালবামের একটা গান –
‘ভোর রাতের নষ্ট প্রায় ভাতের মতো
বিষাদ আমার ভালোবাসা
টি-স্টলের সর পড়া চায়ের মতো
বিবর্ণ আমার প্রেম;
ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট ময়লার মতো
ছড়ানো ছিটানো আমার আবেগ।’
বাপ্পী খানের এই লিরিক যখন এলআরবি করছে, তখন পাশের দেশে কবীর সুমন-অঞ্জন দত্ত-নচিকেতার জয়যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। অথচ ‘সুখ’ অ্যালবামটা আমাদের মনে রাখতে হচ্ছে, ‘চলো বদলে যাই’ বা ‘সেই তুমি’র কারণে।
যারা এলআরবি অপছন্দ করেন, তারা এই অ্যালবামের ‘সুখ’ ও ‘ক্ষণিকের জন্য’ গান দুটো শুনতে পারেন। প্রথমটি পিংক ফ্লয়েড প্রভাবিত এবং দ্বিতীয়তটি এলভিস প্রিসলির কোনো একটা গানের বাংলা আচরণ। এ ধরনের কাজ আরও আছে। সেসব নিয়ে অন্য একদিন বলা যাবে। আপাতত ১৯৯৪ সালের ‘তবুও’ অ্যালবামের দিকে যাওয়া যাক। এখানে এলআরবির ড্রামার মিল্টন আকবর ।
ভদ্রলোক এর আগে মাইলসে ছিলেন। মিল্টন আকবর বাংলাদেশের সেরা ড্রামারদের একজন। কয়েকবছর হল প্রয়াত হয়েছেন। যারা জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমাটা দেখেছেন, তাদের নিশ্চয়ই শওকত আকবরের কথা মনে আছে। রাজ্জাকের বড় ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। মিল্টন আকবর উনার ছেলে। ‘তবুও’ মূলত মিন্টন আকবর আর আইয়ুব বাচ্চুর অ্যালবাম। অবশ্য আমি এসব বলার কারণ তারা নন, ‘মাকে বলিস’ নামের একটা গান। লতিফুল ইসলাম শিবলীর লেখা এই ‘ব্লুজ রক’ নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত এলআরবির সঙ্গে তার প্রথম কাজ। দ্বিতীয়ত তিনি তখন ঘরবাড়ি ছেড়ে স্ট্রাগল লাইফ কাটাচ্ছেন। সেই স্ট্রাগলের সরাসরি ছাপ পড়ছে লেখায়। তিনি লিখেছেন-
‘ইট পাথরের সত্যগুলো গোপন রেখে কল্পনাতে মন গড়া এক শহর এঁকে
মাছে-ভাতে তার ছেলেটা এখন ভালোই আছে বাড়ি ফিরে বন্ধুরে তুই মাকে বলিস।’
এই গানটা খুব বেশি মানুষ শুনেন নি। তারপরেও লতিফুল ইসলাম শিবলি আইয়ুব বাচ্চুর জন্য সৌভাগ্য নিয়ে এসেছিলেন। ‘হাসতে দেখো গাইতে দেখো’, ‘একটা চাকরি হবে চাঁদ মামা’, ‘নীল বেদনা’, ‘বাংকারে ফুলশয্যা’, ‘আহা জীবন’; তার লেখা এসব গান এলআরবিকে নিয়ে গিয়েছিল তরুণ শ্রোতাদের খুব কাছে।
আর আইয়ুব বাচ্চুর সলো ক্যারিয়ার? ‘ময়না’র পরে সলো ক্যারিয়ারে এক দশকের গ্যাপ পরেছিল। ১৯৯৫ সালে পাওয়া গেলো তার তৃতীয় অ্যালবাম। নাম, কষ্ট। কষ্ট পেতে ভালবাসি, কষ্ট কাকে বলে— এসব গান দিয়ে তিনি ছড়িয়ে গেলেন সবখানে। আইয়ুব বাচ্চুর কষ্টবিষয়ক গানগুলোর গীতিকার সেই লতিফুল ইসলাম শিবলী ।
এরপর তিনি দু’হাতে কাজ করেছেন। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে মিড্ড অ্যালবামের জয়যাত্রা শুরু হয়েছে ততদিনে। এসে গেছেন প্রিন্স মাহমুদ ও জুয়েল-বাবু। আরো আগে থেকে ছিলেন আশিকুজ্জামান টুলু। সবার অ্যালবামেই আইয়ুব বাচ্চুর গান। এর বাইরে প্রতি বছর একটি করে ব্যান্ড অ্যালবাম বের হচ্ছে। তিনি সিনেমায় গাইছেন। বিজ্ঞাপনের মিউজিক করছেন। আবার তার সুর ও কম্পোজিশনে অন্যরা গাইছেন। একে একে বের হচ্ছে— ‘তারা ভরা রাতে’, ‘তুমিহীনা সারাবেলা’, ‘ময়ূরী, ‘আসবে তুমি’, ‘আয়না ।’
আইয়ুব বাচ্চুর সুরে অনেকেই গেয়েছেন। সেই তালিকায় ইভা রহমান পর্যন্ত আছেন। শুধু জেমস নেই। জেমসের সুরেও একটি অ্যালবাম আছে— ‘সোনালি বিকেল।” জেমস সেখানে মিতালি মুখার্জির সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছেন। তার জীবনে এই একটিই ডুয়েট গান। ‘তোমাকে বাঁশির মতো বাজাই ৷ ‘
আইয়ুব বাচ্চুর সুর ও কম্পোজিশনে যে-সব অ্যালবাম বের হয়েছে, তার মধ্যে অনেক ভাল গান আছে ৷ এই মুহূর্তে মনে পড়ছে প্রয়াত নিলয় দাসের গাওয়া একটা গান। গানটা যখনই শুনেছি বিষাদ এসে আঁকড়ে ধরেছে। গীতিকার নিয়াজ আহমেদ অংশুর নামে এখন কিছু বিষাদ ডাকা যাক-
‘এ শহর ডুবে যায়, রাত্রির মায়ায়
যখনই ভুলে যাও এই আমায়-
এ শহর কেঁদে যায়, অবহেলায় মিশে যায়
ডুবে থাকা দুঃখের মেলায় ।’
তবে এই গল্প নব্বই দশকের। পরের দশকের আইয়ুব বাচ্চুকে চেনা যায় না। ব্যান্ডের গান শুনলে মনে হয়, সলো গান চলছে। সলো গান শুনলে মনে হয় এর শ্রোতা আমরা নই। অন্য কেউ। যাদের আমরা ঠিক চিনি না। একটু ভুল হলো, তাদেরও আমরা চিনি। লেখার প্রথমেই তো ধার করে এক ম্যাঙ্গোবার বিক্রেতার গল্প বললাম ।
এই সময় অজস্র মিক্সড অ্যালবামে আইয়ুব বাচ্চু তাদের জন্য গান করেছেন। মুখরোচক সব কথা-সুরে ভর্তি ছিল সেসব। কাজেই নানা শ্রেণির লোকজন তাকে ভালবাসবে, তাকে হারিয়ে মন খারাপ করবে-এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। এটা না-হলেই আশ্চর্যের হতো।
এলআরবির শেষ শ্রোতাপ্রিয় গান ‘সাবিত্রী রায়।’ এটা ২০০৭ সালের। সাজ্জাদ হুসাইন লিখেছিলেন। শুধু এটা না, আইয়ুব বাচ্চুর শেষের দিকের সলো-ব্যান্ড অ্যালবামের বেশিরভাগ গান সাজ্জাদ হুসাইনের লেখা। এতোগুলা গান তার জন্য আর কেউ লেখেনি। তাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি শুধু তার গান লিখেন কেন?
তিনি বললেন, আমি আইয়ুব বাচ্চুর গানই লিখতে চেয়েছি।
বাংলাদেশে গায়ক ও কম্পোজারের সংখ্যা অনেক। কিন্তু ক’জন এই ভরসার জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছেন? তার ‘সময়’ অ্যালবামে একটা গান ছিল- ‘বড়বাবু মাস্টার।’ সেই গানের সঙ্গে আইয়ুব বাচ্চুর মিল নেই। তবে তিনি মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির বড়বাবু মাস্টার ছিলেন। ব্রজে তার দখল ছিল দেখার মতো। তার তৈরি বেশিরভাগ গানকেই ব্লুজে টেনে আনা যায়। এর কারণ কি জিমি হেন্ড্রিক্স? উত্তর যাই হোক, বাংলাদেশে এরকম আর একজনই আছেন। তিনি জেমস ।
আইয়ুব বাচ্চু মারা গেছেন-এই খবর আমি বিশ্বাস করিনি। বরগুনায় জেমসের শো দেখে বিশ্বাস করতে হলো। তিনি ফিলিংসের ‘তোমাদের মাঝে কি কেউ আছে বন্ধু আমার?’ এই গানটা বাজাতে-বাজাতে কেঁদে দিলেন। এই দৃশ্যটা দেখে মনে হল, এটা জেমস না, আমি বা আমরা, যেন পুরো বাংলাদেশ একজন হয়ে কাঁদছে।
শিল্পীদের জীবদ্দশায় সম্মান দিই না বলে বাংলাদেশকে অপবাদ দেয়া হয়। তবে এই দৃশ্যটা জানিয়ে দিল কথাটা ঠিক না। আমাদের চেয়ে বেশি ভালবাসার ক্ষমতা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের নেই ।